চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২৭ – চৌদ্দ শাকের খোঁজ
ফরহাদ মজহার ও ফরিদা আখতার || Tuesday 13 April 2021 ||চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের আশে পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে গ্রামের নারী শাক কুড়াতে বেরোয়। শাক খাওয়া শুরু হয় চৈত্র মাসের শুরু থেকেই। নিয়ম আছে চৈত্র মাসের শেষ দিনে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয় কিন্তু, অনাবাদী; অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, পানিতে, চকে আপনজালা বা নিজে বেড়ে ওঠা শাক তুলতে হবে। অর্থাৎ যে শাক লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে - নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। এবং এই মৌসুমে যা টিকে থাকে।
এর মাধ্যমে কৃষক নারী খবর নিতে চায় প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী - যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব- সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা দেখা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, কিষাণি মেয়ে এই দিনে খবর নেয় তারা সব ঠিকঠাক আছে তো? চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সূক্ষ জ্ঞান চর্চা। এই জ্ঞান নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, পাড়া প্রতিবেশীরা ভাগাভাগি করে শেখে। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। আসলে বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে।
নয়াকৃষির সব এলাকায় চৈত্র মাস আসলে শাকের খোঁজ খবর নেয়া হয় এবং কোথায় কত প্রকার শাক পাওয়া গেল তার হিশাব রাখা হয়। সুযোগ পেলে ছবি তোলা হয়। নয়াকৃষি এলাকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে আবাদী জমিতে কোন প্রকার সার কীটনাশক ব্যবহার হয় না এবং বৈচিত্র্য ময় ফসল উৎপাদন করা হয় বলে শাকও তার মনের আনন্দে বেড়ে ওঠে।
এবারের চৌদ্দ শাকের ছবিগুলো তোলা হয়েছে নয়াকৃষি আরশিনগর বিদ্যাঘরের ভেতরে জমি এবং তার আশে আপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে। সেই শাকগুলো পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। চৌদ্দ রকম শাক খুঁজতে ১৫ রকম পাওয়া গেল। মন্দ কি।
আরশিনগর বিদ্যাঘরে চৈত্র্য মাসে কোন শাক কত মিটারের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া শাক পাওয়া গেছে তার তালিকা:
গিমা শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Glinus oppositifolius
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাক পুকুর পাড়ে, জমির আইলে, বাড়ির আনাচে কানাচে, রাস্তার পাশে, পুকুর পারে, গোয়াল ঘরে পাশে, কাচা ঘরের ডোয়াই বোনা আউশ, আমন ধানের মধ্যে চৈতালী ফসলের মধ্যে জন্মে এবং উচু জায়গাতে ভাল জন্মে।
গাছের বর্ণনা: এই শাক গাছটি ছোট লতা জাতীয় গাছ এর পাতা গুলো খুব ছোট ছোট, ডাটা খুবই চিকন, অনেকটা সুতার মত দেখতে। এই গাছের ফুল সাদা সাদা হয়। গাছটি ঘাসের সাথে লেপটে থাকে। পাতাটি তেুঁল পাতার চেয়ে একটু লাম্বা, শাকটি তিতা লাগে খেতে। এর পাতা ১ ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়। প্রতি গিরা থেকে ২টি পাতা বের হয়। এক গিরা থেকে আর এক গিরার দুরুত্ব ১ ইঞ্চি মত। ফলটা জিরার মত দেখতে।
সংগ্রহের পদ্ধতি: গিমা শাক সারা বছরই পাওয়া যায় বর্ষার সময় কম পাওয়া যায়। শীতের সময় বেশি পাওয়া যায়। শাকটির ডগা ও পাতা তোলা হয়।
কোন অংশ খায়: শাকটি তোর সময় ডগা ও পাতা তোলা হয়।
খাওয়ার পদ্ধতি: ভাজি, চরচড়ি, বড়া, রান্না করে খায়।
খাদ্য ও পুষ্টিগুণ: এই শাক ওষুধিগুণাগুণ আছে বিধায় খাদ্য হিসেব গ্রহন করেন। আবার বিশেষ দিনে খেয়ে থাকেন। যেমন-সনের পহেলা সকালে গিমা শাক রান্না করে পান্তা ভাতের সাথে খান। তার কারন হলো, এই শাক ঐ দিনে খেলে এক বৎসর কোন চুলকানি, খুজলী, পাচড়া হবে না।
গিমা শাকটি রিদয়পুর কেন্দ্রের ২১ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
হেলেঞ্চা শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Alternanthera sesilis
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাক পানিতে বেশি ভাল হয়। হেলেঞ্চা শাক নীচু জমিতে, পুকুরে, বাড়ির আশে পাশে, ডোবা-নালা ও খাল বিলে বেশী হয়।
গাছের বর্ণনা: এই হেলেঞ্চা শাক গাছটা একটু মোটা ও গোল আকৃতির হয়। এই গাছের রং হালকা সবুজ এবং পাতার রং গাঢ় সবুজ হয়। পাতাটা লম্বা প্রায় ৩ ইঞ্চি থেকে ইঞ্চি এবং প্রস্হ আধা ইঞ্চি। পাতাটা একটু মোটা হয়। গাছে মাঝে মাঝে স্থানে গিরা আছে এবং গাছের ভিতর ফাঁপা থাকে।
সংগ্রহের পদ্ধতি: হেলেঞ্চা শাক তোলার সময় হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে চিমটি কেটে কচি ডোগাটা। পাতাসহ তোলে। এই শাকের ডোগা যত তোলা হয় তত আরও নতুন ডোগা গজায়। কিন্তু তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন গাছটা মুল সহ ছিড়ে না আচে। মুলসহ ছিড়ে আসলে পুরো গাছটি মরে যাবে।
কোন অংশ খায়: হেলেঞ্চা শাকের শুধু নরম ডাটা ও পাতা ডোগাসহ খায়।
খাওয়ার পদ্ধতি: হেলেঞ্চা শাক ভর্তা, ভাজি ও ঝোল করে খায়।
খাদ্য ও পুষ্টিগুণ: এই শাক সাধারণত অসুখ হলে রান্না করে খান।
হেলেঞ্চা শাকটি কেন্দ্রের ৮ থেকে ৩৫ থেকে ১০৫ থেকে ২১০ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়
তেলাকুচা শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Coccinea cordifolia
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মা: তেলাকুচা লতা জাতীয় গাছ এ গাছ অন্য গাছের সাছে লতিয়ে উপরে উঠে। ঝোপ জংগলে এই গাছ জন্মে। বাড়ির আশ পাশের বেড়াতেও যেখানে বড় গাছ না থাকে সেখানি মাটিতে লুটিয়ে থাকে। এ গাছ ছায়া ও রোদ্রময় সব জায়গাতে কলা গাছে বেশি বেয়ে ওঠে । এই গাছ শুকনা একটা আদ্রতা যুক্ত মাটিতে জন্মে। পাকা ফলের বীজ থেকে আবার নতুন গাছ জন্মে। তেলাকুচা সারা বৎসরই জন্মায়।
গাছের বর্ণনা: তেলাকুচা লতা জাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছ অন্য গাছের সাথে লতিয়ে উঠে। পাতা গাঢ় সবুজ। আকৃতি ছোট পাতার মত। ফল ছোট লম্বাটে। পটলের মত দেখতে। পাকলে সিপুর রঙের হয়। কাচা অবস্থায় সবুজ রঙের থাকে। ফলের গায়ে সাদা সাদা জোড়া কাটা দাগ আছে ফুলটি সাদা রঙের হয় দেখতে মহিকের আকৃতি। গাছের লতা ১০/১২ হাত লম্বা হয়ে থাকে। জ্যৈষ্ট, আষাঢ় মাসে ফুল আসে।
সংগ্রহের পদ্ধতি: এই শাকের লতার কচি ডগা ও পাতা সংগ্রহ করা হয়। ফল ও সংগ্রহ করা হয়। যশোর এলাকাতে এই গাছের কচি ফল অনেকে খেয়ে থাকে।
কোন অংশ খায়: পাতা, ডগা ও ফল খাওয়া হয় নানা ভাবে।
খাওয়ার পদ্ধতি: ভার্তা, ভাজি, বড়া, সালাদ, ল্যাবড়া রতা করে খাওয়া হয়। কাচা ফল শসার মত করে চিবিয়ে খাওয়া হয়।
তেলাকুচা শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৮ থেকে ২১ থেকে ১০৫ মিটার থেকে সংগ্রহ হয়।
থানকুনি শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Centella asiatica
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: বাড়ির আশ পাশ, রাস্তার ধার ও যে কোন শুকনা স্যাঁতসেত জায়গায় এই শাক বেশী জন্মায়। তাছাড়া আবাদি ফসলের আইলের দুই ধার দিয়েও হয়। সব মিলে এই শাক রোদে জন্মাইতে বেশী পছন্দ করে।
গাছের বর্ণনা: এই শাকের পাতা ও ডাটা সহ পুরো গাছটি সবুজ রং। লতা জাতীয় গাছের লতা খুব তারাতারড়ি মাটিতে কচুর লতার মত বয়ে যায়। দেখতে গোল বলে অনেক এলাকায় টাকা পাতাও বলে। ফুল হয় ডাটার মাঝখান থেকে।
সংগ্রহের পদ্ধতি: থানকুনি পাতা যদি মুল সহকারে তুলতে হয় তবে মূল ধরে টান দিয়ে তুলে আনে। আর যদি পাতার দরকার হয় তবে শুধু পাতাটা চিমটি দিয়ে কেটে তুলে আনে। তবে শাকের জন্য শুধু পাতা তুলে আনে। আর । ঔষধের জ্য আনলে পাতা না তুলে কেবল গাছের মূল বা শেকড় আস্তে করে তুলে আনে।
কোন অংশ ব্যবহার হয়: পাতা, মুল ও বীজ।
কোন অংশ খায়: এই শাকের কচি ও বাত্তি পাতা খায় ভর্তা ও সালাদের জন্য। আর ঝোল রান্নার জন্য পাতা সহ ডাটা তুলে আনে।
খাদ্য ও পুষ্টি: মানুষ জানেন, ওষুধিগুণ আছে। আর ওষুধিগুণ আছে বিধায় ভর্তা, শাক ভাজা ও ছোট মাছ দিয়ে চরচরি রান্না করে খেয়ে থাকেন। খোচের জন্য ভাল উপকার করে তাই ভর্তা ও কাঁচা চাসনী করে খান। গর্ভবর্তী মায়ের পানি আসলে ভাজি করে খান। এই পাতা ভিটামিন আছে, অনেক ওষুধিগুণ আছে তাই অনেক সময় রান্না করে তরকারী হিসেবে খান। আবার ওষুধ হিসাবে খান। খাদ্য হিসাবে খেয়ে থাকেন, যখন দেখেন কোন অসুখ দেখা দিয়েছে তখন গাছ থেকে পাতা তুলে রান্না, ভর্তা করে খেয়ে থাকেন।
থানকুনি শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ২১ থেকে ১০ থেকে ১৯৬ থেকে ২২৫ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়
বথুয়া শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Chenopodium album
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: রবিশস্য ও শীতকালীন শাক সবজির ক্ষেতে এই শাক বেশী জন্মে যেমন- গম, সরিষা, ছোলা, মসুরী ও বিভিন্ন প্রকার সবজির ক্ষেতে) জন্মে। জমির আইলেও এই শাক পাওয়া যায়। তবে ইরি ধানের জমিতে এই শাক হয় না। এই শাক জন্মানোর জন্য শুকনা জমি ও শাক পরিবেশের প্রয়োজন হয়।
গাছের বর্ণনা: এই শাক গাছটি উর্দ্ধে ১ ফুটের মত উচুঁ হয়। পাতা ছোট হয়। পাতা ও গাছের রং সবুজ ও সিঁদুর রং এর মিশ্র। গাছটার দিকে তাকালে চিক চিক করে। গাছের গায়ে সাদা পাউডারের মত একটা পদার্থ লেগে থাকে। গাছে ছোট ছোট ফল হয়। পাতায় হাত দিলে বালুরমত একটা পদার্থ হাতে মেখে যায়।
সংগ্রেহের পদ্ধতি: খাওয়ার জন্য এই শাকের ডগা নেওয়া হয়। তবে পরিবেশ ভেদে এই শাক দুই ভাবে সংগ্রহ করা হয়। আবাদী জমিতে জন্মানো শাক শিকরসহ তুলে সংগ্রহ করা হয়। আবার আইলে জন্মানো শাকের পুরা অংশ বা তুলে শুধু পাতা ও গাছের মাথার অংশ তোলা হয়।
কোন অংশ খায়: এই শাকের কচি ডাটা ও পাতা খাওয়া হয়।
খাওয়ার পদ্ধতি: ভর্তা, ভাজি, পিটালু, ঝোল ও বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া হয়।
খাদ্য ও পষ্টিগুণ: বথুয়া শাকে 'ভিটামিন’ আছে। এই শাক ভেজে ও ছোট মাছ দিয়ে ঝোল রান্না করে খান। এছাড়া ছোট বাচ্চাদেরকে রান্না করে ঝোল খাওয়ান। বাচআদের পুষ্টি যোগান গর্ভবর্তী মায়েরা এই শাক বেশি খান। কারণ এই শাক খেলে রক্তশুন্যতা দেখা দেয় না।
বথুয়া শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৩ থেকে ২১ মিটার সংগ্রহ করা হয়।
তিতা হেলেঞ্চা শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Enhydra fluctuans
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাকটা স্যাঁত স্যাতেঁ নরম জায়গায় বেশি হয়। বাড়ির আশে পাশে রাস্তার পাশে এবং জমির আইলে শাক ভাল হয়, এছাড়া পানিতেও হয়।
গাছের বর্ণনা: এই শাকের গাছ দেড় থেকে দুই হাত লম্বা হয়ে থাকে। গাছের গায়ে মাঝে গিরা ও খসখসে আছে। গায়ের রং হালকা বেগুনী ও গাঢ় সবুজ। পাতার রং সবুজ ও পাতাটি কাটালো।
কোন অংশ খায়: শুধু ডোগাটাও পাতা খায়।
খাওয়ার পদ্ধতি: এই শাক ভাজি, মিশ্র ও ঝোল রান্না করে খায়।
তিতা হেলেঞ্চা শাটি আরশিনগর কেন্দ্রের ২৬৭ মিটার সংগ্রহ করা হয়।
ঢেঁকি শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Dryopteris filix-mas
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাক সাধারণত বাড়ির পাশে ঢালে আলানে পালানে ছায়াযুক্ত স্থানে ভিজা মাটির মধ্যে জন্মায়। এছাড়া গ্রামের মাটির রাস্তার দুই ধারদিয়ে এই শাক প্রচুর পরিমানে হয়। গ্রামের মানুষ বলে এই শাক অন্য শাকের লকায় থাকে বলে এর মান ঢেঁকি শাক। এই শাক রোদ সহ্য করতে পারে না। তাই বেশীর ভাগ সময় বড় কোন গাছের ছয়ায় ভাল হয়।
গাছের বর্ণনা: এই গাছ ১হাত লম্বা হয়। ছোপা ছোপা আকারে হয়। এর পাতা খাজ কাটা। গাছটা একটু বাঁকা হয় এবং দুই পাশ দিয়ে পাতা আনে।
কোন অংশ খায়: গাছের মাথায় কচি যে অংশ থাকে সেইটুকু খায়। তবে যে গাছের পাতা বাত্তি হয়ে যায় তা খাওয়া যায় না।
খাওয়ার পদ্ধতি: মাছ দিয়ে ঝোল করে, ভাজি করে, মরিচ বাটা ও করল্লার সাথে ভাজি করে খাওয়া যায়।
ঢেঁকি শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৫ থেকে ১০৫ মিটার সংগ্রহ করা হয়।
কানাই শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Commelina benghalensis
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাক পতিত জমি, গোবর সারের গাঁদা, বা আখের ক্ষেতে জন্মে। যে জমিতে জৈবসার বেশি দেয়া হয় সেই জমিতে প্রচুর পরিমাণে কানাই শাক জন্মে। আখ বছরি ফসল বলে আখ ক্ষেতে কানাই শাক জন্মায়। আর শেকড় থেকে এই শাক বংশ বিস্তার করে চলে। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস কানাই শাকের ভরা মৌসুম।
গাছের বর্ণনা: কানাই শাক তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। মাটি বেয়ে এ শাক এগুয়ে যায়। গিট থেকে শিকড় বেড়িয়ে মাটি আকড়ে ধরে থাকে। শাক গাছটি মাটিতে লতিয়ে চললেও অগ্রভাব ৩/৪ ইঞ্চি উচু হয়ে থাকে। কোনাই শাকের পাতা ১ ইঞ্চির মত লম্বা। পাতার পেটা আধা ইঞ্চি মোটা হয়ে থাকে। গাছের প্রতিটা গিট থেকে ২টা করে পাতা বেরোয়।
কোন অংশ ব্যবহার হয়: পাতা ও কচি ডাটা।
খাদ্য ও পুষ্টিগুণ: এই শাক রান্না করে খেলে শরীরে পুষ্টি যোগান দেয়। বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভুগলে এই শাক রান্না করে খাওয়ালে পুষ্টি যোগান দেয়।
কানাই শাকটি আরশিনগর কেন্দের ৮ থেকে ২১ থেকে ২২৩ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
খারকুন শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Typhonium trilobatum
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: এই শাক গাছ পালার মাঝে, বাড়ীর আশে পাশে, পালানে, পরিত্যেক্ত ভিটায়, উচু জায়গায়, রাস্তার ধারে আখ ক্ষেতে, পুকুরের পারে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় জন্মে থাকে। খারকুন দুই প্রকার লাল খারকুন ও সাদা খারকুন। সারা বৎসরই পাওয়া যায়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি হলে বেশী হয়। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে বেশী জন্মে। ভাদ্র আশ্বিন মাসে গাছে ফুল আসলে তখন আর ফুল খায়না।
গাছের বর্ণনা: খারকুন ঝোপ জাতীয় (গুল্ম)সপুস্পক উদ্ভিদ। ১/২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে ছায়াযুক্ত জায়গায় লম্বা বেশী হয়। এর পাতা দেখতে অনেকটা কচুপাতার মত। কাণ্ডটি মাটির নীচ থাকে। আর সব পাতা মাটির উপরে থাকে।
কোন অংশ খায়: খারকুন পাতা দুই ভাবে তোলা হয়। ভর্তা খাওয়ার জন্য পাতা ও রান্না করে খাওয়ার জন্য মাটির উপর থেকে ডাটা কেটে আনে।
খাওয়ার পদ্ধতি: ভর্তা,বাঁটা,তরকারী এ তিন পদ্ধতিতে খাওয়া হয়।
খারকুন শাকটি কেন্দ্রের ৪ থেকে ২১ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
ঘাগরা শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Xanthium strumarium
শাকটির কচি ডাটা ও কচি পাতা খায়।
ঘাগরা শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ১০৫ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
কচু শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Colocasia esculenta
কচু শাক কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: বাড়ির আলানে পালানে, মাঠে ঘাটে, সড়কের পাশে চকের আইলে এই কচু শাক জন্মে থাকে। উঁচু জায়গায় কচু শাক ভাল হয়। এছাড়া ভিজা ও স্যাঁতসাতে জায়গায় খুব সন্দর তরতাজা হয়। আর রোদ্রযুক্ত জায়গায় চিকন হয় বেশি জোয়ের হয় না। এই কচু ছায়াঅ তেমন ভাল হয় না।
গাছের বর্ণনা: এই কচু শাকের গাছটা ভেজা জায়গা হলে আড়াই তিন হাত পর্যন্ত বড় হয়। কিন্তু রোদ্রে হলে ১ থেকে ২হাত পর্যন্ত বড় হয়। এই কচু পাতা গোল ও সবুজ হয়। ডাইগার রং গাঢ় সবুজ হয়। এই গাছের ফুলটা হলুদ। আর ফুলের মাঝখান দিয়ে লম্বা একটা শির বের হয়। কচু গাছে যখন ফুল ফোটে তখন সুন্দর এক ধরণের গন্ধ বের হয়। এই কচুর লতি বেশ বড় হয়।
সংগ্রহ পদ্ধতি: কচু শাকের ডগা বা ডাটা কাটলে কাচি দিয়ে কেটে হাতে পাঞ্জা করে নিয়ে আসা হয়। আর কেবল পাতা তুললে হাতে ছিড়ে বাড়ি নিয়ে আসে হাতে বা চালুনে করে।
কোন অংশ খায়: কচু শাকের পাতা, ডাইগা, লতি মুখী ও ফুল সহ সবই খাওয়া যায়।
খাওয়ার পদ্ধতি: পাতা ডাইগা দিয়ে শাক রান্না করে খাওয়া হয়। বড় বড় ডাইগা ইলিশ মাছ দিয়ে ঘন্টা খাওয়া হয়। লতি ও মুখী ঝোল করে খাওয়া হয়। ফুল দিয়ে ডালের সাথে ঘন্টা করা হয়। এছাড়া মোতা মাছ দিয়ে ঝোল করে খাওয়া হয়।
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি: এটা সংরংক্ষণ করা লাগে না। কারণ যতই তুলে খাওয়া হয়। ততই মোতা থেকে আবার গাছ হয়। পরবর্তীতে আবার পাওয়া যায়।
কচু শাটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৮ থেকে ২১ থেকে ২৪৬ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
কলমি শাক
বৈজ্ঞানিক নাম: Ipomoea reptons poir
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: বাড়ির পাশে দোপা নীচু জমিতে এই শাক জন্মে। আবার বড় কোন বিল বা ডোবায়ও এই শাক প্রচুর পরিমানে হয়। নতুন পুকুরের পানিতেও এই ভাসা কলমি হয়। আবার অনেকে সক করে এই শাকের ডগা বিল থেকে তুলে এনে নিজের পুকুরের পানিতে ছাড়ে। ভাসা কলমি পুকুরের পানিতেও সংরক্ষিত হয়।
গাছের বর্ণনা: কলমির জাত কয়েকটি আছে। যেমন ভাসা কলমি, চাটকলমি, দুধকলমি,পানিকলমি ও আবাদি কলমি। ভাসা কলমি, চাটকলমি, দুধকলমি ও পানিকলমি এমনিতেই হয়। অর্থাৎ কেউ কলমির আবাদ করে না। প্রকৃতির দেয়া পানিতেই কলমি শাকগুলো হয়ে থাকে। তবে এক একটার রং ও বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম।
ভাসা কলমির পাতা ও গাছের রং শিইলা রং এর পাতা চিরল চিরল ও লম্বা। এই কলমি স্বাভাব হলো পানি যত বাড়বে এই শাকও ততটা বাড়বে। বন্যার পানি চলে গেলে এই কলমিকে আর দেখতে পাওয়া যায় না।
দুধকলমির পাতা ও গাছ দেখতে সবুজ। পাতার আকার চিরল চিরল। ভাসা কলমির চেয়ে এই কলমির উচ্চতা বেশী। পানিকলমি এই কলমির ডগা ও পাতা একটিু মোটা। আর রং বেশী গাঢ় সবুজ। আবাদি কলমি এই কলমি গ্রামের কৃষক আবাদ করে আর অন্য শাকের মত করে। এর বীজ কৃষক ঘরে রেখে দেয়।
সংগ্রহের পদ্ধতি: এই শাক বেশীর ভাগ মলিারাই সংগ্রহ করে থাকে। মহিলারা ও ছোট বাচ্চারা দল বেধে এই শাক তোলে। তারা এমন ভাবে তোলে যেন পানিথে পুরো গাছটি উঠে না আসে। তারাও পানিতে কলমির মত করে ভেসে এই শাকের আগা ও ডগা তোলে।
কোন অংশ খায়: এই শাকের কচি ডগা ও পাতা খাওয়া হয়।
খাওয়ার পদ্ধতি: এই শাকের ভর্তা, ভাজি, ঝোল, চড়চড়ি, পিটালু ও ঘন্ট করে খায়।
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পদ্বতি: কারো জমিতে ভাসা কলমি শাক উঠলে পাড়া প্রতিবেশী গরীব লোকজন জমি থেকে কুড়িয়ে এনে খায়। জমি থেকে শাক তুললে কেউ বাধা দেয় না। শাক তোলার সময় দল বেঁধে আনন্দ ফুর্তির সাথে শাক কুড়ায়। শাক তুলতে গিয়ে অন্যের সাথে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।
কলমি শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৮ থেকে ২২৩ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
আমখৈরা শাক
বৈজ্ঞানিকনাম: Amaranthusviridis
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: বাড়ির আশে পাশে, ঘরে ডুয়ার আশেপাশে পাওয়া যায়। বাড়ির উঠানে অন্য শাকসবজির মধ্যে জন্মায়। বিশেষ করে গোবরে স্তুপের উপর বেশি হয়।
গাছের বর্ণনা: আমখৈরা শাক দুটি জাতের হয়। লাল ও সাদা। ফাল্গুন মাসে এই শাক জমিতে উঠা শুরু হয়। শাকটি বেশিদিন খাওয়া উপযোগী থাকে না। গাছে অনেক শাখা প্রশাখা হয়। লম্বায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাত হয়। গজানোর ১৫-২০দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলতে হয়। এর শীষ বের হয়। শীষ থেকে বীজ হয়। একই মৌসুমে দুইবার হয়। ফাল্গুন বৈশাখ মাস পর্যন্ত থাকে। নয়াকৃষি কৃষকরা বীজ সংগ্রহ করে বীজঘরে রাখেন ।অন্যান্য শাকের মতো চাষও করা যায়। তবে চাষ করে না বললেই চলে। নয়াকৃষি গ্রামে এমনিতেই অনেক হয়।
সংগ্রহের পদ্ধতি: মহিলা ও বাচ্চারা খুব সহজেই সংগহ করতে পারে। বাড়ির কাছেই এই শাক পাওয়া যায়। এমনও আছে মহিলারা চুলায় ভাত রান্না করা অবস্থায়ও শাক তুলে রান্না করে খায়।
কোন অংশ খায়: এই শাকের পাতা ও কচি ডগা খায়। এই শাক তুলে বেশিখন রাখা যায় না। শুখিয়ে যায়।
খাওয়ার পদ্ধতি: আমখৈর শাক ভাজি, ভর্তা বেশি খাওয়া হয়।
সংগ্রহ, সংরক্ষণওব্যবস্থাপনাপদ্বতি: এই শাক নয়াকৃষি এলাকায় খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমখৈর শাক বাড়ির আশে পাশে পাওয়া যায়।এ কারনে বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশিরা গল্প করতে করতে শাক সংগ্রহ করে। এই শাক বেশিখন সংরক্ষন করে রাখা যায় না। তারাতারি রান্না করে খেতে হয়।
আমখৈরা শাকটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৪ থেকে ১০৫ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
আম্রল শাক
বৈজ্ঞানিকনাম: Oxalis corniculata
কোথায় এবং কোন পরিবেশে জন্মায়: আম্রল শাক বাড়ির আশেপাশে হয়। তবে বেশি হয় ফসলের জমির আইলে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধানের জমির আইলে বেশি হয়।
গাছের বর্ণনা: আমখৈরা শাক এক জাতের হয়। আম্রল শাক সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীতে কম হয়। গাছটি ছোট সাইজের । মাটির সাথে চাক বেধে থাকে। অনেক ঘন হয়। শাখা প্রশাখা অনেক। গজানোর এক মাস পর থেকে খাওয়া শুরু হয়। যত শাক তোলা ততো শাখা প্রশাখা বাড়ে, শাকও বাড়ে।একটি গাছ থেকে পাঁচ থেকে সাতবার শাক সংগ্রহ করা যায়। গাছে হলুদ ফুল হয়। তবে বীজ সংগ্রহ করা হয় না, এমনিতেই হয়।
সংগ্রহের পদ্ধতি: মহিলা ও বাচ্চারা খুব সহজেই সংগহ করতে পারে। বাড়ির কাছেই এই শাক পাওয়া যায়। জমির আইলে পাওয়া যায়। শাকের ডগা সংগ্রহ করা হয়।
কোন অংশ খায়: এই শাকের পাতা ও কচি ডগা খায়। এই শাক তুলে বেশিখন রাখা যায় না। শুখিয়ে যায়।
খাওয়ারপদ্ধতি: আম্রল শাক তাজা ভর্তা, কাচা পাতা খায়, ভাজি করে খায়। টক রান্না করেও খাওয়া হয়।শাকটি খেতে অনেক টক।
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাপদ্বতি: আম্রল শাক নয়াকৃষি গ্রামের মাঠে, বাড়ির পাশে খুব সহজেই পাওয়া যায়। প্রতিবেশিরা একসাথে এই শাক তুলতে যায়। শাক তুলে ধুয়ে কাচা ভর্তা করা যায়। এবং রান্না করা যায়। এই শাক বেশিখন সংরক্ষন করে রাখা যায় না। তারাতারি রান্না করে অথবা কাচা খেতে হয়।
আম্রল শাটি আরশিনগর কেন্দ্রের ৪ থেকে ২১০ মিটার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
ছবি তুলেছেনঃ আবুল কালাম